বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

রমজানে সহমর্মিতার প্রতিফলন চাই

শাহীন হাসনাত:
রহমত তথা দয়া আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা আল্লাহতায়ালা তার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক করেন, অধিকন্তু তিনি কেবল তার দয়ালু বান্দাদের প্রতিই দয়া করেন। মহান আল্লাহ রহমান, রাহিম চিরদয়ালু; পরম করুণাময়। তাই তিনি দয়ালুদের ভালোবাসেন এবং সবাইকে পারস্পরিক দয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। সৃষ্টিগতভাবে প্রতিটি মানুষ দয়ার গুণপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে নানা কারণে এসব গুণ লোপ পায়। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর অন্যতম হলো

আল্লাহর অবাধ্যতা : সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অবাধ্যতা মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করে। চেতনাকে নি®প্রভ করে। ফলে অব্যাহত অবাধ্যতার কারণে একটা পর্যায়ে এসে সে অনুভূতিশূন্য হয়ে যায়। তখন তার হৃদয় পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে যায়। সহজাত দয়ার গুণ হারিয়ে ফেলে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে বনী ইসরাইলের অবস্থা বিশদভাবে বর্ণনার পাশাপাশি আল্লাহর বিধানের প্রতি তাদের ঔদ্ধত্য প্রদর্শন বিষয়ে শাস্তির কথাও বর্ণনা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণেই তো আমি তাদের অভিসম্পাত করেছি এবং তাদের অন্তর কঠিন করে দিয়েছি।’ সুরা মায়িদা : ১৩

সম্পদের বড়াই ও স্বেচ্ছাচারিতা : এই স্বভাবটি অত্যন্ত ভয়ংকর। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বস্তুত মানুষ প্রকাশ্য স্বেচ্ছাচার করছে। কেননা, সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে।’ সুরা আলাক : ৬-৭

অর্থাৎ দুনিয়ায় অর্জিত মানুষের ধন-দৌলত, সম্মান-প্রতিপত্তি যা কিছু রয়েছে, এগুলোকে নিজের অর্জন মনে করা। এসব পেয়ে কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে নিজেকে অহংকারী করে তুলেছে। এই স্বভাব অত্যন্ত মন্দ।

অত্যধিক পানাহার : মানুষের দয়া কমে যাওয়া কিংবা বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাব্য একটি কারণ অত্যধিক পানাহার। কেননা, পানাহারের আধিক্য অন্তরে দম্ভ ও অহংকার সৃষ্টি করে। তখন নিজেকে বড় ও স্বয়ংসম্পন্ন মনে হতে থাকে। অন্যদিকে অন্যকে ছোট ও তুচ্ছ মনে হতে থাকে।

রোজার ভূমিকা : অন্তরের এসব ব্যাধি নিরাময়ে রোজার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাই তো আমরা দেখতে পাই, রোজা পালনকারী সাধারণ মানুষের প্রতি অধিক দয়াশীল হয়। কারণ, তিনি নিজে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে সারা দিন ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করেছেন। ফলে অবচেতন মনে অন্য মুসলমানের প্রতি তার দয়া ও করুণা সৃষ্টি হয়। মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়।

বস্তুত সব মুসলমানের উচিত সর্বদা অপর মুসলিম ভাইয়ের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা। দায়িত্বশীল ব্যক্তি তার অধীনদের প্রতি দয়া দেখাবে। তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করবে। তাদের প্রতি সহমর্মী হবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইয়া আল্লাহ! আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি কোনো দায়িত্ব পেয়ে অধীনদের প্রতি কঠোরতা করে, আপনি তার প্রতি কঠোরতা করুন। আর যে সহজতা করে আপনি তার জন্য সহজ করুন।’ সহিহ মুসলিম : ১৮২৮

বর্ণিত হাদিসের আলোকে শিক্ষককে দয়ার গুণে গুণান্বিত হতে হবে। তারা ছাত্রদের প্রতি দয়া দেখাবে। তাদের সঙ্গে কোমল ভাষায় কথা বলবে। সুন্দর আচরণ করবে। এতে তারা শিক্ষার্থীদের সশ্রদ্ধ ভালোবাসা পাবেন এবং শিক্ষার্থীরাও খুব সহজেই তাদের জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হবে; অধিকন্তু আল্লাহতায়ালাও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। তাদের উত্তম প্রতিদান দেবেন। কোরআন মাজিদে এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.)-এর প্রশংসা করে ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে নবী!) এসব ঘটনার পর এটা আল্লাহর রহমতই ছিল। যদ্দরুন তুমি মানুষের সঙ্গে কোমল আচরণ করেছো। তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির কঠোর হৃদয়ের হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত।’ সুরা আলে ইমরান : ১৫৯

ইমাম তার মুসল্লিদের প্রতি দয়া দেখাবে। তাদের সঙ্গে প্রজ্ঞা ও হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করবে। যেসব সামাজিক কাজে তার অংশগ্রহণ সাধারণ মানুষের জন্য আনন্দদায়ক ও কল্যাণকর, সেসব কাজে নেতৃত্ব দেবে। আনুষঙ্গিক কাজকর্মে যেন মুসল্লি ও সাধারণ মানুষের কষ্ট না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবে। কখনো তাদের প্রতি কঠোরতা করবে না এবং তাদের কষ্টের কারণ হবে না। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ইমাম হবে, সে যেন নামাজ অতি দীর্ঘ না করে। কারণ, মুসল্লিদের মধ্যে বৃদ্ধ, অসুস্থ, শিশু, প্রয়োজনগ্রস্ত সব ধরনের মানুষই থাকে।’ সহিহ মুসলিম : ৪৬৬

অনুরূপভাবে ইসলাম প্রচারকরা সাধারণ মানুষের প্রতি সদয় আচরণ করবে। তাদের সঙ্গে কোমল ভাষায় কথা বলবে। বিনম্র ভাষায় দাওয়াত দেবে। কোনো কথা, কাজ ও স্বভাবের কথা উল্লেখ করে তাকে লজ্জিত করবে না। আঘাত করে কথা বলবে না। মানুষের সামনে কারও দোষ বর্ণনা করবে না।

সন্তান যেমন মা-বাবার প্রতি সম্মানজনক আচরণ করবে, তেমনি সন্তানের প্রতিও তারা দয়া দেখাবেন। সন্তানের প্রতি মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসা, আন্তরিকতা, কোমল আচরণ সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির পথকে সুগম করে। কল্যাণের পথে হাত ধরে এগিয়ে নেয়।

শুধু উল্লিখিত বিষয়ে নয়, সর্বক্ষেত্রে-সর্বাবস্থায় যাবতীয় কঠোরতা ও বাড়াবাড়ি পরিহারযোগ্য। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নম্রতা যেকোনো বিষয়কে সুশোভিত করে তোলে। আর কঠোরতা যেকোনো বিষয়কে অসুন্দর করে তোলে।’

দেখুন, আমার-আপনার মতো হাজার হাজার আদম সন্তান বাস্তবিক অর্থে অনাহারে-অর্ধাহারে রয়েছে। এক লোকমা খাবারের জন্য ফুটপাতে বসে কাতরাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছে, অসংখ্য মানুষ কারাগারে ছটফট করছে। অনেক বাবা তার সন্তানের লজ্জা নিবারণের জন্য একটা কাপড় হন্যে হয়ে খুঁজছে। অনেক মা সন্তানের ক্ষুধার জ্বালা মেটানোর জন্য অন্যের কাছে হাত পাতছে। হাজার হাজার বেকার কর্মসংস্থানের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছে। বিভিন্ন অফিস-আদালতে অন্যায়ভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছে প্রচুর মানুষ। এসব সমস্যার সমাধান কে করবে? এগুলো নিরসনে আমাকে-আপনাকেই এগিয়ে আসতে হবে। সামর্থ্য ও দয়ার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

হে রহমতের নবীর উম্মত! এখনো কি সময় আসেনি একটু দয়াপরবশ হওয়ার? এখনো কি সময় হয়নি অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হওয়ার? এই ব্যথাই যদি আপনি-আমি অনুভব না করি, অন্যের পাশে না দাঁড়াই, কারও উপকারে না আসি, তাহলে রোজা আমাদের কী শিক্ষা দিল? আর রোজার শিক্ষা জীবনে প্রতিফলিত না হলে এই রোজা উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজান হলো সমবেদনা ও সহমর্মিতার মাস।’ সেই রমজানের দুই-তৃতীয়াংশ আমরা পার করছি, সামনে আছে আর মাত্র কয়েকটা দিন। এখনই সময় নিজেকে গড়ার, পরিবর্তন করার।

লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION